প্রকাশিত: Sat, Jun 17, 2023 8:38 PM আপডেট: Sat, Dec 6, 2025 2:23 PM
৪৪ বছর কারাভোগ শেষে আজ মুক্তি পাচ্ছেন জল্লাদ শাহজাহান
মিজানুর রহমান সোহেল, ফেসবুক থেকে: বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দিন কারাভোগ করলেন প্রধান জল্লাদ মো. শাহজাহান ভূঁইয়া। ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ তার জন্ম। স্বাধীনতা দিবসে জন্মগ্রহণ করলেও জীবনের বেশিরভাগ সময় পরাধীন জীবনযাপন করেছেন।
তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ ঘাতক, ৬ জন যুদ্ধাপরাধী, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যার আসামী খুকু মনির, ডেইজি হত্যা মামলার আসামী হাসানসহ বাংলাদেশের আলোচিত প্রায় ৪০ জনের ফাঁসি দিয়েছেন।
১৯৭৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর ৩৬টি মামলায় তার ১৪৩ বছরের সাঁজা হয়। পরে ৮৭ বছর জেল মাফ করে তাকে ৫৬ বছরের জন্য সাজা দেওয়া হয়। ফাঁসি কার্যকর ও সশ্রম কারাদণ্ডের সুবিধার কারণে সেই সাজা ৪৩ বছরে এসে নামে। দুইটি মামলায় ৫০০০ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে ৬ মাস করে অতিরিক্ত এক বছর জেল খেটে ৪৪ বছর পর আজ মুক্ত আকাশে শ্বাস ফেলার সুযোগ পাবেন জল্লাদ শাহজাহান।
২০১২ সালের ৩১ জুলাই ফৌজদারি ৫৪ ধারায় সন্দেহজনক একটি মামলায় কারাগারে গেলে জল্লাদ শাহজাহানের সাথে আমার পরিচয় হয়। মূলত তার তত্ত্বাবধানেই আমি ছিলাম। তৎকালে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের মেঘনা-২ ভবনে ১৫ দিনের কারাভোগের সময় জানতে পারি সে ৩৩ বছর ধরে কারাগারে আছেন। এই সময়ে সে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে একজন সাংবাদিক কারাগারে আসলে তাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য টাকাও দেন। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়নি। আমি দায়িত্ব নিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিলাম। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি দেওয়ার পর তার কেইস কার্ডে (কারাগারের আইডি কার্ডে) সর্বশেষ তোলা ছবিটি লুকিয়ে নিয়ে আসি। ছবিটি আলাদা করে এঁকে সেই সাক্ষাৎকারটি ২০১২ সালের ২০ মার্চ দৈনিক যুগান্তরে বিশেষ কাভারেজ হিসেবে (১৩ নাম্বার পেজে) ফুলপেজ প্রকাশ করে। একইসাথে বিরল এই সাক্ষাৎকারের জন্য একই পেজে কীভাবে আমি এই সাক্ষাৎকার নিলাম সেটা নিয়েও আমার ছবিসহ একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে যুগান্তর। একই সাক্ষাৎকার বিডিনিউজ, প্রিয় ডটকম এবং তৎকালে সামহোয়্যারইন ব্লগসহ অনেক জাগায় প্রকাশ হয়। তখন ব্লগিং যুগ ছিল এবং আমার এই লেখা পড়ে অনেক ব্লগার নিরব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জল্লাদ শাহজাহানের মুক্তি চেয়ে আন্দোলন করেন, লেখালেখি করেন। তার মুক্তিচেয়ে ঢাকার অনেক দেওয়াল লেখনিও দেখেছি তখন।
আজ গুগলে সার্চ করে দেখলাম বহু সংবাদমাধ্যমে তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে এবং তার সবটুকু তথ্যই আমার দেওয়া। কারণ এই বাইরে কোনো তথ্য কারও কাছে নেই। আরও কিছু তথ্য আপনাদের জন্য শেয়ার করছি। প্রায় ১১ বছর পর ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের মেঘনা বিল্ডিংয়ের ৪ তলায় ৮ নম্বর রুমে গেলে জল্লাদ শাহজাহান আমাকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরেন। তিনি অনেক না বলা কথা বলার জন্য যেন ছটফট করছিলেন। তবে সে এখন অসুস্থ আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ। শরীরের গঠনও জীর্ণশীর্ণ। কাছ থেকে দেখলেই বোঝা যায়, রোগ–শোকে অনেকটাই ক্লান্ত তিনি। প্রথমদিন কুশল বিনিময় করলেও নানান সময় গিয়ে তার সাথে দেখা করতাম, গল্প করতাম। অতীতের গ�ানি এবং আগামীদিনের স্বপ্নের কথা বলতেন। তিনি এবার জানালেন, আমার বিরুদ্ধে করা সবগুলো মামলা ষড়যন্ত্রমূলক ছিল। প্রায় একই সময়ে অনেক জেলায় আমার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। যদিও হাইকোর্টে পরে অধিকাংশ মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং আমি সেগুলো থেকে খালাস পেয়েছি। শেষে দুটি হত্যা মামলা ও একটা অস্ত্র মামলায় নিজের পক্ষে রায় পাইনি। তার দাবি, নিয়ম অনুযায়ী আমার কারাভোগ শেষ হয়েছে আগেই কিন্তু আমাকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। বিশেষত ৫ হাজার টাকা করে দুটি মামলায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাস করে এক বছর জেল যেন না খাটতে হয় সে জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
তার কারাগারে আসার পর ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ৮২টি কেইস কার্ড হয়েছে। তিনি সেগুলো সযত্নে একটা বইয়ের মত করে বাইন্ডিং করে রেখেছেন। আমি যতটা সম্ভব তার কেইস কার্ডের তথ্যগুলো স্ট্যাডি করলাম। তার কেইস কার্ড যেন কারাগারের জীবন্ত ইতিহাস। কবে কারাগারে আসলেন, কবে কোন কারাগারে ট্র্যান্সফার হলেন, কাকে ফাঁসি দিলেন, কবে নিজের চিকিৎসা করালেন বা ডাক্তার দেখালেন, কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী তাকে লুঙ্গী, গামছা, রেডিও বা অন্য আরও যা কিছু পেয়েছেন তার সব তথ্যই কেইস কার্ডে আছে। তার প্রথম কেইস কার্ড নাম্বার ২৬৯৮। কেইস কার্ডে তারিখ অস্পষ্ট। সেখানে লেখা- খন্দকার মুসা খালেদ, জেলা ও দায়রা জজ, মানিকগঞ্জ ৯(এ)(এফ) অস্ত্র আইনে ১৯৯২ সালের ৮ নভেম্বর সশ্রম ১২ বছর সাজা, ৫০০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাস জেল। ডেইট অব রিলিজ ০৭.১১.২০০৪ লেখা। তবে তার নামে একাধিক মামলার রায় হওয়াতে একটির পর একটি সাজা খাটাতে ডেইট অব রিলিজ অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে। তবে সব কিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল তিনি কারামুক্ত হবেন।
১৯৮৯ সালে সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে শাহজাহান তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করে। এরপর কারাগারে মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়নের সময় আসলেই তার ডাক পরে। টানা আট বছর এই কাজ করার পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেন। আমি যখন তার সাথে কথা বলছিলাম তখন জানালেন, সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৭ জুন রাত ১১টায় সিলেটের নতুন কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথমবারের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সিরাজুল ইসলাম সিরাজ (৫৫) নামের একজনের ফাঁসি কার্যকর করেন। ফাঁসি কার্যকর করা তার কাছে ডাল-ভাত হলেও তিনি একদম গাড়ি জার্নি করতে পারেন না। বমি আসে। ঢাকা থেকে সিলেটে ফাঁসি কার্যকর করতে গিয়ে গাড়িতে কয়েকবার বমি করেছেন। তাই সে দূরের জার্নি করতে চান না। যদি জল্লাদ শাহজাহান মুক্তি পাওয়ার আগে সর্বশেষ ফাঁসি কার্যকর করেছেন চলতি বছর ৮ জানুয়ারি। ওইদিন রাত ১০টায় গাজীপুরের কাশিমপুর হাই-সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-৪ এ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি বগুড়ার মালতিনগর নামাপাড়া এলাকার মোজাম ফকিরের ছেলে সাইফুল ইসলাম রফিকের (৫০) ফাঁসি কার্যকর করেন।
জল্লাদ শাহজাহানের পরিচয় : পুরো নাম মো. শাহজাহান ভূঁইয়া। জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ। জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। তিন বোন এক ভাই। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া। মাতা সব মেহের। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম খাস হাওলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন পারলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং সর্বশেষ উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন নরসিংদী সরকারি কলেজে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত। ১৯৭৪ সালে তিনি এইচএসসি পাশ করেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার হচ্ছে- ২৬৯১৬৪৯১০৬১২৯।
সেনাবাহিনীতে ছিলেন তিন বছর : ছোট থেকেই সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড তাকে খুব আকর্ষণ করতো। বিশেষ করে তাদের শৃঙ্খলাবোধ তার সব থেকে বেশি ভালো লাগতো। তাই মনে প্রাণে সব সময় স্বপ্ন দেখতেন সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করবেন। বাবার মাধ্যমে তিনি একবার খবর পান সেনাবাহিনীতে লোক নেওয়া হচ্ছে। এরপর সেনাবাহিনীর চাকরির জন্য অংশগ্রহণ করলে তিনি টিকে জান। যথা সাধ্য তিন বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর বড় অফিসারদের ধমকের কারণে জিদ করে বাড়ি চলে আসেন। তিনি বলেন অফিসারদের কমান্ড আমার ভালো লাগতো না। কারণ আমি তাদের থেকে পড়াশোনা এবং পারিবারিক দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিলাম। তিনি চাকরি করবেন না বলে ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তার সেনাবাহিনীতে চাকরি করার স্বপ্নের কবর এখানেই রচিত হয়।
নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায?িত্ব গ্রহণ : স্বাধীনতার যুদ্ধ জয়ের চার বছর পর। তখন তিনি তরতাজা তরুণ। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেছেন দুই বছর আগে। মনের অজান্তে ভালো লেগে যায় কমিউনিস্ট পার্টি। সেখানে তার নাম লেখিয়ে ফেলেন। তার পারফরমেন্স দেখে কেন্দ্রে থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয়। তাকে নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায?িত্ব দিতে চাইলে তিনি রাজি হন। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি জেলার দায?িত্ব গ্রহণ করেন।
অপরাধ জগতে প্রবেশের ইতিবৃত্ত : ছেলে হিসেবে শাহজাহান খুবই ভালো ছেলে ছিলেন। পারতপক্ষে করও উপকার ছাড়া ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন না। তবে সে প্রচণ্ড বন্ধু পাগল মানুষ ছিলেন। একবার তার গ্রামে নারী ঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। শাহজাহানের দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে। গ্রামে তাকে নিয়ে বিচারে বসা হয়। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণিত করে তাকে সাজা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই তার ক্ষিপ্ততা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নিবেন। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। তারপর অনেক লম্বা ইতিহাস।
যেভাবে আটক হন : নারীঘটিত ওই ঘটনার পরে তিনি বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যেকোনো অপারেশনে তার চাহিদা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেতে থাকলো। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন করেছিলেন ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায় এবং এটাই ছিল তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। সেখানে তার অপারেশন শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেক পোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে জান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকগঞ্জে পুলিশের সাথে গুলাগুলিও হয় কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওনা হন প্রতিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে ফেলে। তার গতিময় জীবনের এখানেই সমাপ্তি এবং এরপর থেকে তার বন্দী জীবন শুরু।
৩৬টি মামলা ১৪৩ বছরের জেল : ১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১টি অস্ত্র মামলা, ১টি ডাকাতি মামলা এবং অবশিষ্ট ৩৪টি হত্যা মামলা। বিচারকার্যে দেরি হওয়ার কারণে সাজা ছাড়াই তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ১৭ বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকেন। ১৯৯৫ সালে তার সাজা হয় ১৪৩ বছর। পরে ৮৭ বছর জেল মাফ করে তাকে ৫৬ বছরের জন্য জেল দেওয়া হয়। শাহজাহানের জেল থেকে বের হওয়ার তারিখ তার জেল কার্ডের ওপর লেখা ছিল “ডেইট অব রিলিজ ২০৩৫”। তবে ফাঁসি কার্যকর, সশ্রম কারাদণ্ড এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে রেয়াদ পেয়ে ৪৪ বছরের মাথায় তার ডেইট অব রিলিজ এখন ১৮.০৬.২৩২৩।
জল্লাদ হিসেবে আত্ম-প্রকাশ : জীবনের সোনালী সময়গুলো তাকে এখানেই কারাগারেই কাটাতে হবে- এমন ভাবনা থেকে তিনি চিন্তা করলেন জল্লাদ হিসেবে সময় দিলে তার সাজা কিছু দিনের জন্য হলেও কম হবে। তাই নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথম ১৯৮৯ সালে তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এটাই তার জীবনের প্রথম কারাগারে কাউকে ফাঁসি দেওয়া। তার যোগ্যতা দেখে ৮ বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের আসন প্রদান করেন। প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামী হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন। তিনি জানান একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সাথে ৬ জন সহযোগী লাগে এবং ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের ২ মাস ৪ দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়। এছাড়া কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
তার দেওয়া কিছু উল্লেখযোগ্য ফাঁসি : ২২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি আলোচিত প্রায় ৪০টি ফাঁসি কার্যকর করেছেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবথেকে বেশি ফাঁসি দেওয়ার রেকর্ড। তার দেওয়া কিছু উল্লেখযোগ্য ফাঁসিগুলো হচ্ছে- ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামী খুকু মুনির, ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামী হাসান, ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদার, ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামী এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তার, ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আরেক আসামী পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ, ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ কাশিমপুর ও ৯ ময়মনসিংহে জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার মামুন, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদ, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, ২০১৬ সালের ১১ মে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী, ২০২০ সালের ৫ মে (কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রথম ও একমাত্র ফাঁসি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদসহ প্রায় ৪০ জনের ফাঁসি কার্যকর করেন। শাহজাহান যখন কাউকে ফাঁসি দেন তখন পত্র-পত্রিকায় তাকে নিয়ে অনেক লেখা-লেখি হয়। তিনি যথা সম্ভব কারাগারে বসেই ওইসব পত্রিকাগুলোর কপি সংগ্রহ করেন। তিনি নিয়মিতভাবে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা পড়েন বলে তার সংগ্রহে যুগান্তরের কাটিং সবচেয়ে বেশি।
পরিবারের সাথে শাহজাহানের সম্পর্ক : শাহজাহান বাম রাজনীতি করতো বলে তার বাবা তাকে খারাপ চোখে দেখত। জীবনের সোনালী মুহূর্তে যখন তিনি কারাগারে প্রবেশ করেন তারপর থেকে তার বাবার সাথে আর কোন দিন যোগাযোগ হয়নি। মা বেচে থাকা অবস্থায় নিয়মিত দেখতে আসলেও বাবা কোন দিন জেল গেটে তাকে দেখতে আসেনি। এমনকি বাবার মৃত্যুর ২ মাস পর খবর পান তার বাবা আর বেচে নেই। বেচে আছেন তিন বোন। তারা থাকেন বাবার রেখে যাওয়া ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের ১১২ নাম্বার বাড়ীতে। এখানে শাহজাহানদের ৬ কাঠা জমি আছে। তিনি অভিযোগ করেন, সব জমি বোনেরা নিয়ে নিয়েছে। এই বোনেরাও তাকে ২০/২৫ বছর আগে একবার দেখতে এসেছিল। তারপর আর কোন খবর নেই। তিনি জানান সর্বশেষ ২০১০ সালে একদিন তার বোনের ছেলে দেখতে এসেছিল। তারপর তারাও আর খবর নেয়নি।
বাংলাদেশের জল্লাদ ও ফাঁসির পরিসংখ্যান : অভিযুক্ত কয়েদীদের মৃত্যুদণ্ড ফাঁসিতে যেসব দেশে কার্যকর করা হয় তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৭১ সালে এ দেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তারপর থেকে ৪ শতাধিক মানুষকে এদেশে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের কারাগারগুলোর কনডেম সেলে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীর সংখ্যা ২ হাজার ১৬২ জন। যার মধ্যে পুরুষ বন্দি রয়েছেন ২ হাজার ৯৯ জন। এছাড়া নারী বন্দি রয়েছেন ৬৩ জন। কেন্দ্রীয় কারাগার ছাড়াও দেশের আরও ১৪টি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ আছে। ফাঁসি দেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ম্যানিলা থেকে ১০ হাজার ফাঁসির রশি আমদানি করা হয় বাংলাদেশে। এরপর আর কোনো রশি আনা হয়নি। ওই রশি দিয়েই মূলত: সবাইকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কারা অধিদপ্তরের হিসাবমতে বর্তমানে দেশে কারাগারের সংখ্যা ৬৮। এর মধ্যে ৫৫টি জেলা কারাগার এবং ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এসব কারাগারে বন্দির সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার ৮৬০। এর মধ্যে হাজতি বা বিচারাধীন বন্দি ৬৫ হাজার ৩৯২ জন, যা মোট বন্দির ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া বিচারের পর সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৪৬৮। বিচারাধীন বন্দির সংখ্যায় এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে আর বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। ফাঁসি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে কয়েক ডজন জল্লাদ আছেন। তার মধ্যে প্রসিদ্ধ (যারা নূন্যতম পাঁচজন আসামীকে ফাঁসি দিয়েছেন) জল্লাদরা হচ্ছেন- নরসিংদীর শাহজাহান ভূঁইয়া, ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের ছেলে তানভীর হাসান রাজু (২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছেন), গাজীপুরের হাফিজ উদ্দিন, কক্সবাজারের বাবুল মিয়া (২০১১ সালে মুক্তি পেয়েছেন), সাভারের কালু মিয়া, গোপালগঞ্জের শেখ মো. কামরুজ্জামান ফারুক ও শেখ সানোয়ার, ফরিদপুরের আবুল, জয়নাল বেপারী ও মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকার মোহাম্মদ মাসুম, মনির হোসেন, নেত্রকোনার মোহাম্মদ বাবুল।
জল্লাদ শাহজাহানের কিছু অভিযোগ ও কিছু অনুরোধ : জল্লাদ শাহজাহানের সাথে আমার দুই দফা দেখা হলে দুইবারই কিছু অনুরোধ করেন। ২০১২ সালে বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ছিল আমি তাদেরকে ফাঁসি দিয়েছি। আমি আশা করেছিলাম শেখের মেয়ে এখন প্রধানমন্ত্রী সে আমার দিকে একটু সুনজর দিবে। কিন্তু আমার কথা কেউ বিবেচনা করলো না। এখন আমার অপরাধ করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনটায় নেই। আমাকে তিন দশকের অধিক সময় ধরে কারাগারে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে যা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। মানবিক দিক বিবেচনা করলে একটি মানুষ জীবনের শেষ বয়সে এসে আশার আলো দেখতে পারেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো যেন তার সামান্যতম সহানুভূতি দেখান সে ব্যাপারে তিনি বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। এদিকে ২০২১ সালে তিনি বলেন, আমি কারাগার থেকে মুক্ত হলে কোথায় যাবে? আমার বাড়ি-ঘর নেই। আমাকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবে কে? তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে প্রথমে প্রেস কনফারেন্স করতে চান এবং এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখ করতে চান। সুযোগ থাকলে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নে বসবাস করতে চান এবং সেখানে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচন করার স্বপ্ন দেখেন।
যাই হোক, আগামীকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ব্যক্তিত্ব দেশের প্রধান জল্লাদ শাহজাহান মুক্ত জীবনে ফিরে আসবেন সেটাই বড় সংবাদ। তিনি ফিরলে কারা জীবনের অনেক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে জানা যাবে। কীভাবে কারাগারে নানান পট পরিবর্তন হলো। সেটা রাজনৈতিক পরিবর্তন হতে পারে, সেটা সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলোও আসতে পারে। গত ৪৪ বছরে লাখ লাখ মানুষ কারাগারে এসেছেন তাদের সম্পর্কেও বলতে পারবেন। তবে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয়, ফাঁসির সময় আসামীরা কে কি বলেছিলেন বা তাদের এক্সপ্রেশন কেমন ছিল তার সবচেয়ে বড় স্বাক্ষী তিনি। তাকে নিয়ে বই লেখকরা বই লিখতে পারেন। যারা ক্রিমিনলোজি নিয়ে পড়াশোনা করেন বা এ বিষয়ে গবেষণা করতে চান তারা জল্লাদ শাহজাহানের বেঁচে থাকা সময় পর্যন্ত তার থেকে নানান তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। আমার কাছেও তার সম্পর্কে আরও অসংখ্য তথ্য রয়েছে সেগুলো এখানে প্রকাশ করলাম না। কারও ব্যক্তিগত আগ্রহ থাকলে সময় নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
এখানে ২০১২ সালের ২০ মার্চ দৈনিক যুগান্তরে ফুলপেজে প্রকাশিত আমার সাক্ষাৎকারটির ছবি দিলাম। একই সাথে কারাগার থেকে নিয়ে আসা। ফেসবুক থেকে